রাজস্ব ফাঁকি দিতে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টকে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) নিচ্ছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান টিআইএন নিলেও প্রতিবছর রিটার্ন জমা দিচ্ছে না। শুধু এসব অনিয়মেই শেষ নয়, কিছু কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিতে ভুয়া অডিট রিপোর্টও দাখিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে। এসব অনিয়ম বন্ধ করতে এবার কঠোর হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ইতোমধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) পরিচালককে প্রধান করে করপোরেট কমপ্লায়েন্স টাস্কফোর্স নামে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গঠন করেছে এনবিআর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সারাদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধক প্রতিষ্ঠান আরজেএসসিতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। অথচ প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেয় মাত্র ৩০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা দেয় না। এতে প্রতিবছরই বিশাল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অনেক অসাধু প্রতিষ্ঠান শুধু যে রিটার্ন দেয় না তাই নয়, কর ফাঁকি দিতে ভুয়া অডিট রিপোর্ট এনবিআরের দাখিল করে। দীর্ঘদিন ধরে এসব অনিয়ম চলে আসছে। চাইলেও এসব অনিয়ম বন্ধ করতে পারছে না রাজস্ব আহরণকারী রাষ্ট্রয়াত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। রিটার্ন জমা নিশ্চিত করা এবং ভুয়া অডিট রিপোর্ট বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করছে এনবিআর। এই লক্ষ্যে এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে প্রধান করা হয়েছে এনবিআরের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্ট সেলের (সিআইসি) পরিচালক শাব্বির আহমদকে। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কর অঞ্চল-১৫ এর যুগ্ম কর কমিশনার ওয়াকিল আহমদ, কর অঞ্চল গাজীপুরের যুগ্ম কর কমিশনার সুলতানা হাবীব, সিআইসির উপপরিচালক ফাতেমা খাতুন, কর অঞ্চল-৭ এর সহকারী কর কমিশনার ফারহাত তাসনীম। এই কমিটির নাম দেয়া হয়েছে করপোরেট কমপ্লায়েন্স টাস্কফোর্স।
এই কমিটির কাজে আইটি সহায়তা দেবেন এনবিআরের প্রোগ্রামার আমিনুর রহমান, সহকারী প্রোগ্রামার এমডি মেহেদী হাসান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এনবিআর এর আগেও বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। আসলে ভালো উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু সময়মতো তা বাস্তবায়ন হয় না। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সরকারের রাজস্ব আহরণ আরো বাড়বে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এনবিআর সূত্রে আরো জানা গেছে, বছরে আয়কর রিটার্ন জমা দেয় এমন কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। অর্থাৎ নিবন্ধনের মাত্র ১৫ শতাংশ কোম্পানি রিটার্ন দেয় কিন্তু আইন অনুযায়ী বছর শেষে রিটার্ন জমা দেয়া সব কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক। আর আয়কর আইন অনুযায়ী, করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার বা টিআইএন থাকলেই রিটার্ন দিতে হবে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানের টিআইএন থাকার পরও রিটার্ন দিচ্ছে না। জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন নেয়ার পর কোন কোন কোম্পানির টিআইএন আছে, আর কোন কোন কোম্পানির নেই, তা নিয়ে জরিপ করেছে এনবিআর। ২০২০ সালে গঠিত সাত সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স এ জরিপ করে। এই জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯০ হাজার কোম্পানির টিআইএন নেই। এসব কোম্পানি জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন নিলেও এনবিআর থেকে টিআইএন নেয়নি। টিআইএনবিহীন ওই সব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ পাঠিয়ে করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এত দিন কোম্পানিগুলোর বার্ষিক রিটার্ন ও কর দেয়ার কথা থাকলেও তারা তা দেয়নি। এতে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালে প্রায় ৭৭ হাজার কোম্পানির টিআইএন ছিল। যাদের ছিল না, তাদের বাধ্য করা হয়। ফলে এখন টিআইএনধারী কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজারে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন নিয়েছে অথচ রাজস্ব বোর্ড থেকে টিআইএন নেয়নি। ওই সব প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে বের করে ক্রমান্বয়ে করের আওতায় আনা হচ্ছে।
এনবিআরের গঠিত এই টাস্কফোর্স কমিটির কাজের পরিধিতে বলা হয়েছে, আরজেএসসিতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের আয়কর নিবন্ধন হালনাগাদ করা, সব কোম্পানির রিটার্ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেয়া। ভুয়া অডিট রিপোর্ট বন্ধের বিষয়ে এই কমিটি কোম্পানি করদাতার কর নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল এবং সঠিক রিপোর্ট দাখিল নিশ্চিত করবে। সেই সঙ্গে কোম্পানির এসব কার্যক্রম সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে এবং অগ্রগতি রিপোর্ট দেবে এই কমিটি। এসব কার্যক্রম নিয়মিতভাবে এনবিআর চেয়ারম্যানকে অবহিত করতে হবে বলেও বলা হয়েছে।